*গত বছরের তুলনায় এখন কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে দুই গুণ
*নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া না হলে মশার ঘনত্ব চরমে পৌঁছাবে
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানী ঢাকায় গত বছরের তুলনায় এখন কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে দুই গুণ। এখনই মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া না হলে এক মাসের মধ্যে মশার ঘনত্ব চরমে পৌঁছাবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। তবে সিটি করপোরেশন বলছে, মশক নিধনে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এক সপ্তাহ ধরে রাজধানীতে দেখা দিয়েছে মশার উপদ্রব। দিনে কিংবা রাতে নগরজুড়ে যেন মশার রাজত্ব। নোংরা বদ্ধ পানিতে জন্মায় কিউলেক্স মশা। এ জন্য নগরের লেক, নালা খাল বা ড্রেন এখন মশার ভাগাড়।
মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী। অভিযোগ সিটি করপোরেশনের ছিটানো ওষুধেও কাজ হচ্ছে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, চলতি মৌসুমে গত বছরের তুলনায় মশার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় দুই গুণ। যা আরো বাড়ার আশংকা করা হচ্ছে।
তবে সিটি করপোরেশনের দাবি, মশক নিধনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছে তারা। অভিযানের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সচেতন হওয়ার আহ্বান করপোরেশনের।
এই মুহুর্তে বৃষ্টির মাধ্যমে কিউলেক্সের লার্ভা ধ্বংস হলে, মশার ঘনত্ব কিছুটা কমবে বলে মনে করছেন কিটতত্ত্ববিদরা।
বর্তমানে ঢাকাবাসী বাসাবাড়ি-কর্মস্থান কোথাও কিউলেক্স মশার উপদ্রব থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না। কয়েল জ্বালিয়ে, ওষুধ স্প্রে করেও মশার হাত থেকে নিস্তার মিলছে না। কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে জলাশয়, নর্দমা ও আবর্জনা পরিষ্কার করার পাশাপাশি লার্ভা নিধন গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কার্যক্রম জোরালোভাবে চালানো হচ্ছে দাবি করলেও ভুক্তভোগীরা বলছেন ভিন্নকথা। তাদের মতে, সিটি করপোরেশনের কাজ লোক দেখানো।
প্রধান সড়কের পাশ ধরে ওষুধ স্প্রে করেন মশক নিধন কর্মীরা। ভেতরের গলিতে তাদের খুব একটা দেখা মেলে না। এছাড়া অভিজাত এলাকাকে যেভাবে গুরুত্ব দেন, অন্য এলাকাকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় না।
জানা যায়, রাজধানীতে প্রায় ৭৫০কিলোমিটার বক্সকালভার্ট ও কাভার্ড ড্রেন রয়েছে। যেগুলোয় দুই সিটি মশার ওষুধ ছিটাতে পারে না। আর প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী, পলিথিন, ডাবের খোসাসহ বিভিন্ন আবর্জনায় ওই ড্রেনগুলো ভরাট থাকে।
যে কারণে ড্রেন দিয়ে পানি নিষ্কাশন হয় না। জমাটবদ্ধ এসব পানিতে কিউলেক্স ভয়াবহরূপে বংশবিস্তার করছে। এসব স্থানে মশার প্রজনন ধ্বংস করতে কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না।
এছাড়াও জলাশয়, খাল, নর্দমা এবং যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী ও ডাবের খোসার পানিতে ভয়াবহরূপে মশা বংশবিস্তার ঘটাচ্ছে। মশক নিধনে দুই সিটির পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রয়েছে।
তারপরও নগরবাসীকে মশার ধকল সইতে হবে কেন-এমন প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ৮৫ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বরাদ্দ ২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, কিউলেক্স মশার প্রজননে আবহাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে আরও আগ থেকে ঢাকার দুই সিটিকে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেনি। এজন্য এবারও ঢাকাবাসীকে মশার ধকল সইতে হবে-এমনই মনে হচ্ছে।
সারা বছর জলাশয়গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। আর মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রজনন উৎস জলাশয়, কাভার্ড ড্রেন এবং আবর্জনার কারণে মশার উপদ্রব বাড়ছে।
মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে সারা বছর জরিপ পরিচালনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকার মশক নিধন ব্যবস্থাপনায় এখনো সেটা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, কিউলেক্স মশার প্রাদুর্ভাবের ব্যাপারে সিটি করপোরেশনকে সতর্ক করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কিউলেক্স মশার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে।
সিটি করপোরেশন কার্যকর প্রস্তুতি নিতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। নইলে নগরবাসীকে এবারও ধকল সইতে হবে। কেননা এবারও কিউলেক্সের প্রাদুর্ভাব স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দুই সপ্তাহ ধরে মশার উপদ্রব ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বলা চলে, ঢাকায় এখন রীতিমতো মশার রাজত্ব চলছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, বাজার, উন্মুক্ত স্থান, সড়ক, পার্ক, খেলার মাঠ, মসজিদ যেখানেই যান না কেন-মশার উপদ্রব থেকে কোনো নিস্তার মিলছে না।
দুই সিটির ব্যর্থতার কারণে মশার কয়েল, স্প্রে, মশারি বিক্রিও বেড়েছে। এসব পণ্যের বিক্রি বাড়াতে কৌশলগত কারণে রাজধানীতে মশার উপদ্রব বাড়ানো হয়েছে বলেও সংক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ অভিযোগ তুলছেন।
মুগদা মনিকনগরের গোলাম মাওলা বলেন, মশক নিধন কর্মীরা প্রধান সড়কের আশপাশে মশার ওষুধ ছিটাচ্ছে। ভেতরে মশার ওষুধ ছিটাচ্ছে না। এ কারণে মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।
মিরপুর চিড়িয়াখানা এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, মশার উপদ্রব অনেক বেড়েছে। ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব কমতে না কমতে কিউলেক্স ভয়াবহরূপ ধারণ করেছে। সিটি করপোরেশন ডেঙ্গি ও কিউলেক্স কোনোটিই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাহলে এ সংস্থা থেকে লাভ কী?
ইমন হোসেনের বাসা খিলগাঁওয়ের শাহজাহানপুরে। আর অফিস কুড়িল চৌরাস্তায়। বাসা ও অফিসের সূত্রে তার দুই সিটির মশার উপদ্রবের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি বলেন, কিউলে´ মশার উপদ্রব এত বেড়েছে যে বাসায় থাকা সম্ভব হচ্ছে না। কয়েল জ্বালিয়ে ও স্প্রে করেও কাজ হচ্ছে না। সিটি করপোরেশনকে এ ব্যাপারে আরও তৎপর হতে হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর দক্ষিণের মেয়র বলেছিলেন আগে মশাকে নগরবাসী ভয় পেত, আর তার সময়ে মশা নগরবাসীকে ভয় পাবে। তার কথার কোনো বাস্তবায়ন দেখছি না। এছাড়া উত্তরের মেয়র কলকাতা থেকে মশা মারার বিদ্যা রপ্ত করেছেন। এটা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হয়েছে। তারও কোনো সুফল তো দেখছি না।